নির্বাক ও সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র

imhrauntor
15 Min Read

নির্বাক ও সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র

এমন টাইটেল দেখে নিশ্চইয়ি বুঝতে পারছেন আজকের লেখা রবীন্দনাথের সব চলচ্চিত্র তা নিয়ে , আমি জমিয়ে আলোচনা করব কারন বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট টুকরো টুকরো আলাপ রয়েছে আমি আমার এক্সপেরিয়ান্স ও রিসোর্সে রবীন্দনাথের নির্বাক ও সবাক চলচ্চিত্রের উপর করব।

নির্বাক ও সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র
This Image Source By online Media

বিদেশি চলচ্চিত্রে শেক্সপীয়র যতোটা ব্যাপকতায় গৃহীত এবং শিল্পচর্চার মাধ্যমে স্বীকৃত, ভারতীয় চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ সেই পরিমাণে আলোচিত প্রতিভূ নন। তার একটা কারণ, বাংলা ভাষার আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথ যতোটা কাছের মানুষ, বিভিন্ন প্রাদেশিক মানুষের কাছে তাঁর আকর্ষণ ততোটা নয়। রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতীয় সাহিত্যেই নন, বিশ্বসাহিত্যের যে কোনো শ্রেষ্ঠ কীর্তির পাশে স্থান পাবার যোগ্য। তবু আমরা চলচ্চিত্রে তেমন সার্থকতায় তাঁকে পাইনি। দু’ একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসাহিত্যের উৎকৃষ্ট রূপায়ণ ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

প্রথমত চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসাহিত্যের সার্থক রূপায়ণে মূল সাহিত্যরস অনুধাবনে পরিচালকের অজ্ঞতা, দ্বিতীয়ত উৎকৃষ্ট সাহিত্যের যথাযথ চলচ্চিত্রায়ণে সিনেমা ও সাহিত্যের প্রাথমিক ও অপরিহার্য শর্তগুলি সম্পর্কে পরিচালকদের অজ্ঞানতা ও উদাসীনতা।

রবীন্দ্রসাহিত্য বিশেষ ভাবেই মননধর্মী রচনা।

তাঁর বর্ণনাধর্মী রচনাতেও মননপ্রধান রূপ মিশে গেছে। অন্যান্য সাহিত্য নিদর্শনের তুলনায় তাই রবীন্দ্র-সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণ কিছুটা দুরূহ। তাঁর সাহিত্যে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষ উভয়ই বিদ্যমান আছে, এবং তা বিশেষভাবেই এক দার্শনিক প্রজ্ঞা আর ভাবানুষঙ্গে মূর্ত হয়ে আছে। তাঁর সাহিত্যের এই শিল্পরহস্যটি উপলব্ধি না করলে, চলচ্চিত্রায়ণে বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আধুনিক চলচ্চিত্রের শিল্পউপযোগিতায় যতোটা সার্থক, তাঁর উপন্যাস ততোটা নয়। রবীন্দ্রসাহিত্যের অতি সূক্ষ্মতা এবং চলচ্চিত্রায়ণে তার শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র নির্মাতাকে প্রাথমিকভাবেই সতর্ক থাকতে হয় যে, রবীন্দ্ররচনার কোন্ কোন্ অংশ চলচ্চিত্র মাধ্যমের কাছাকাছি।

রবীন্দ্রনাথ যখন ৩৪ বয়সের যুবক, চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যমটির জন্মলগ্ন তখন সূচিত হয়। আর তাঁর প্রবীণ বয়সে তিনি বিদেশ সফর কালে বিদেশি চলচ্চিত্র দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং সিনেমা মাধ্যমটির অভিনবত্ব সম্পর্কে মন্তব্যও করেছিলেন। তার চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে তাঁর ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ রচনায়। রবীন্দ্রনাথ জার্মানি ভ্রমণকালে যীশুখ্রিস্টের ‘প্যাশন প্লে’ দেখে উদ্বুদ্ধ হন।

সেখানে জার্মানির UFA কোম্পানি কবিকে একটি চিত্রনাট্য লিখে দেবার অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথের তদানীন্তন সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তীর একটি পত্রে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথের এই চিত্রনাট্যটি হলো 'The Child' (শিশুতীর্থ)।

নির্বাক যুগ থেকেই রবীন্দ্রসাহিত্য অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের নিদর্শন পাই আমরা। নির্বাক যুগে রবীন্দ্র কাহিনি নিয়ে যে ক’টি ছবি তৈরি হয় সেগুলির কোনোটিই চলচ্চিত্রের শিল্পসংজ্ঞায় আলোচিত হবার যোগ্য নয়। এমনকী সবাক যুগেও, রবীন্দ্রনাথের কাহিনি আশ্রিত অনেকগুলি ছবিকেই সার্থক চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা যায় না। সবাক যুগের পর্বে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে হিন্দি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় ৬টি ছবি তৈরি হয়।

তার মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয়তা পেলেও শিল্পের নিরিখে কোনোভাবে সেগুলি উল্লেখযোগ্য নয়। কেননা প্রায় ক্ষেত্রেই এসব ছবির পরিচালকেরা ছবির পর্দায় নাট্যভঙ্গিতে কাহিনি-গ্রন্থনেই ব্যস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রকাহিনির সূক্ষ্ম তাৎপর্য, চিত্রকল্প, প্রতীকী চেতনা এবং কাহিনির অন্তর্গত মনস্তাত্ত্বিক স্বরূপ চলচ্চিত্রের বিন্যাসে আবিষ্কার করতে পারেননি।

১৯২৩ সালে রবীন্দ্রকাহিনি নিয়ে প্রথম নির্বাক ছবি ‘মানভঞ্জন’ তৈরি হয়, পরিচালক ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। তখনকার দিকপাল শিল্পীদের অভিনয়পুষ্ট হয়েও ছবিটি ব্যর্থ হয়েছিল। এর বছর চারেক পরে তৈরি আর একটি নির্বাক রবীন্দ্রচলচ্চিত্র নির্মান হয় যা সাহিত্য গবেষক উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের একটি লেখাইয় আমি পেয়েছিলাম। যাই হোক…

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক অবলম্বনে এই ছবিটি তৈরি হয়। ছবিটি ছিল ৭ রীলের। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জুবিদাবানু ও সুলোচনা। মানভঞ্জন গল্পটি নিয়েই ১৯২৯ সালে আর একটি ছবি হয়। গল্পের নায়িকার নামানুসারে ছবির নাম দেওয়া হয় ‘গিরিবালা’। পরিচালক ছিলেন মধু বসু।

ঐ একই বছর আরো একটি রবীন্দ্রচলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিলো ছবির নাম ‘বিচারক’। পরিচালক ছিলেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী। ১৯৩০ সালে ‘ডালিয়া’ নামে একটি রবীন্দ্রচলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ছবিটি সম্পর্কে পরিচালক মধু বসু তাঁর আত্মকথায় বেশ কিছু সংবাদ জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে ছবিটির বিজ্ঞাপনে কোথাও পরিচালক মধু বসুর নাম নেই।

১৯৩২ সালের ৩রা জুন কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে মুক্তি পায় 'নৌকাডুবি', পরিচালক ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। সবাক ছবি রূপে তৈরি হবার কথা থাকলেও নানারকম আর্থিক কারণে ও কপিরাইট সংক্রান্ত গণ্ডগোলে শেষ পর্যন্ত ছবিটি নির্বাক হয়েই মুক্তি পায়।

সবাক যুগের গোড়া থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে চল্লিশটির অধিক ছবি তৈরি হয়েছে। এর অনেকগুলিই রবীন্দ্রনাথের অতি বিখ্যাত এবং শ্রেষ্ঠ রচনার অন্তর্ভুক্ত। ছবিগুলোর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। কিন্তু প্রকৃত শিল্পোত্তীর্ণ ছবি হিসেবে এর মধ্যে কয়েকটিকেই মাত্র গণ্য করা যায়।

Star Stories

রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি এক ধরনের সম্ভ্রম ও ভয় থেকে কেউ আদ্যন্ত কাহিনির সব খুঁটিনাটিকে চিত্রিত করার দিকে ঝুঁকতেন, কেউ সামান্য পরিবর্তন, পরিমার্জনায় একটু অভিনব হতে গিয়ে সৃজনী ক্ষমতার অভাবে ব্যর্থ হতেন। এ দুয়ের মাঝখানে তাই রবীন্দ্র চলচ্চিত্র সম্পর্কে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আকর্ষণ কোনো দিনই গড়ে ওঠেনি আর অধিকাংশ ছবিও শিল্পসার্থক হয়ে ওঠেনি।
নির্বাক ও সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র

সবাক যুগের প্রথম রবীন্দ্রচলচ্চিত্র হলো ‘চিরকুমার সভা’।

নির্মিত হয় ১৯৩২ সালে। পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। ছবিটি অত্যন্ত বিরূপ সমালোচনা পেয়েছিল। ঐ একই বছর মুক্তি পায় ‘নটীর পূজা’। পরিচালক ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এরপর ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে গোরা, চোখের বালি, শোধবোধ, শেষরক্ষা, নৌকাডুবি, দৃষ্টিদান, মালঞ্চ, বৌ ঠাকুরাণীর হাট, শেষের কবিতা, চিত্রাঙ্গদা, এই দশটি ছবি মুক্তি পায়। ১৯৪২-এ সৌমেন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘শোধবোধ’ নাটক চলচ্চিত্রায়িত করেন। দু’বছর পরে তৈরি হয় ‘শেষরক্ষা’। পরিচালক ছিলেন পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। এ ছবি সম্পর্কেও ভালোমন্দ মিশিয়ে খুব মামুলি সমালোচনা তদানীন্তন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

১৯৪৭ সালে নীতিন বসুর পরিচালনায় বম্বেতে ‘নৌকাডুবি’ ছবিটি নির্মিত হয়। এই ছবিকে অনেকে সার্থক রবীন্দ্রচলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করেছেন। নীতিন বসুর পরিচালনায় ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। এ ছবি সম্পর্কে ‘দীপালি’ পত্রিকায় কিছুটা নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার আভাস লক্ষ করা যায়। সমালোচনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং শিল্পসার্থকতার কিছু উপকরণ নিয়ে এখানে আলোচনার প্রচেষ্টা ছিল।

১৯৫৩ সালে তৈরি মধু বসু পরিচালিত ‘শেষের কবিতা’ ছবিটিকে অনেকে ক্লাসিক রবীন্দ্রচলচ্চিত্র রূপে গণ্য করেন। বাংলা সিনেমার একদা জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার স্বর্গত নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।

১৯৫৬ সালে আমরা একটা উপভোগ্য ছবি পেলাম ‘চিরকুমার সভা’। পরিচালক ছিলেন দেবকী কুমার বসু। ১৯৩২-এ তৈরি প্রেমাচ্চুর আতর্থীর ‘চিরকুমার সভা’র তুলনায় দেবকীবাবুর এ ছবি অনেক দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য ছবি। ছবিটি দর্শক আনুকূল্য ও সমালোচকদের অভিনন্দন পায়। ঐ একই বছর তপন সিংহের পরিচালনায় তৈরি হয় ‘কাবুলিওয়ালা’। বাস্তবিক এই প্রথম চলচ্চিত্রের পর্দায় রবীন্দ্রনাথের অতি বিখ্যাত গল্পের সর্বজনগ্রাহ্য রূপ প্রতিফলিত করার চেষ্টা দেখা যায়।

এরপর ১৯৬০-এ মুক্তি পায় ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। পরিচালক ছিলেন ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী। গল্পটির মধ্যে চলচ্চিত্রানুগ পরিবেশ বিন্যাসের বহু গুণ থাকলেও পরিচালকেরা তার সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। ঐ বছরই তপন সিংহ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ চলচ্চিত্রায়িত করেন। পরিচালকের উৎকৃষ্ট কল্পনা শক্তির অভাবে এই অসাধারণ গল্পটির অতীন্দ্রিয় রহস্য চেতনা, পরিবেশ, গল্পের সূক্ষ্মতা ছবির পর্দায় ফুটে ওঠেনি। অভাবনীয় ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করলেও চলচ্চিত্রের শিল্পশর্তে এ ছবি শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে পড়ে না

নির্বাক ও সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র

১৯৬১ সালে হিন্দিতে ‘কাবুলিওয়ালা’ নির্মাণ করেন হেমেন গুপ্ত। তপনবাবুর আর একটি রবীন্দ্রচলচ্চিত্র ‘অতিথি’। মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। ছবিতে কিছু সুন্দর দৃশ্যক্রম আছে, কিছু ভালো কম্পোজিশন আছে, মোটামুটি ভালো অভিনয় আছে। সেইসঙ্গে চলচ্চিত্রের পর্দায় গল্প বলার জনপ্রিয় ভঙ্গিটাও লক্ষণীয়। তবু ছবিটি উৎকৃষ্ট রবীন্দ্রচলচ্চিত্র নয়। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের চারটি কবিতা নিয়ে ‘অর্ঘ্য’ নামে একটি ছবি হয়। পরিচালক ছিলেন দেবকীকুমার বসু। অতিথি যে বছর নির্মিত হয় সেই সময়ে আমরা আর একটি ছবি পাই ‘নিশীথে’ (১৯৬৩)। পরিচালক ছিলেন অগ্রগামী গোষ্ঠী। এটিও রবীন্দ্রচলচ্চিত্রের ব্যর্থ নিদর্শন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে এক অসাধারণ রবীন্দ্রচলচ্চিত্র পেয়েছিলাম ‘তিনকন্যা’।

শুধু রবীন্দ্রচলচ্চিত্রে নয়, সর্বভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে এক অনবদ্য শিল্প নিদর্শনরূপে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এ ছবি ইতিহাস হয়ে আছে। পোস্টমাস্টার, মণিহার ও সমাপ্তি এই তিনটি গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের অনুপম শিল্পসৌন্দর্য নির্মাণ করেছেন। ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ ১৯৬৪ সালে আর এক অনবদ্য রবীন্দ্রচলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। বাস্তবিক, এযাবৎ নির্মিত সবকটি রবীন্দ্রচলচ্চিত্রের মধ্যে সত্যজিতের ‘চারুলতা’ নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। চলচ্চিত্র ভাষায়, ব্যাকরণের ঈর্ষণীয় প্রয়োগ নৈপুণ্যে এবং সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক বিষয়ে সত্যজিতের গভীর শিল্পবোধ মিলেমিশে ছবিটি শিক্ষণীয় নিদর্শন হয়ে আছে। আসলে সত্যজিৎই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যিনি, রবীন্দ্রসাহিত্যের দুস্তর পরিবর্তন সাধন করে আপন সৃজনী ক্ষমতায় এমন এক শিল্পরূপ নির্মাণ করলেন, যার মধ্যে রবীন্দ্রসাহিত্যের মূল রস অক্ষুন্ন থেকেও একই সঙ্গে এক ভিন্ন শিল্প নির্মিতির মুখোমুখি হলাম আমরা।

চারুলতা ছবির দুই দশক পরে সত্যজিৎ আর একখানি গুরুত্বপূর্ণ রবীন্দ্র চলচ্চিত্র উপহার দিলেন ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৫)। কিন্তু ‘চারুলতা’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’র মধ্যবর্তী সময়ে আমাদের আরো কয়েক খানি ছবির মুখোমুখি হতে হয়। ছবিগুলি রবীন্দ্রচলচ্চিত্র হিসেবে তেমন সার্থক নয়।

Start Filmmaking

যেমন

পার্থপ্রতিম চৌধুরীর শুভা ও দেবতার গ্রাস১৯৬৪
অরুন্ধতী দেবীরমেঘ ও রৌদ্র’১৯৬৯
মৃণাল সেনের‘ইচ্ছাপূরণ১৯৭০
অজয় করেরমাল্যদান, ১৯৭০
নৌকাডুবি১৯৭৯
স্বদেশ সরকারশাস্তি১৯৭০
বীরেশ্বর বসুবিসর্জন১৯৭৪
পূর্ণেন্দু পত্রীরস্ত্রীর পত্র১৯৭৩
মালঞ্চ১৯৭৯
শংকর ভট্টাচার্যশেষ রক্ষা১৯৭৭
স্বদেশ সরকারদিদি১৯৮৪

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় ও সন্তোষ ঘোষালের পরিচালনায় ‘ছেলেটা’ (১৯৮৬) ইত্যাদি ছবি। একুশ শতকে রবীন্দ্রসাহিত্যাশ্রিত প্রথম ছবি হলো ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘চোখের বালি’ (২০০২)। ছবিটি কোনো-কোনো মহলে প্রশংসিত হলেও নানান বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে। এরপর উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রচলচ্চিত্র আর যে-কটি নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে আছে কুমার সাহনীর ‘চার অধ্যায়’ (২০০৩), সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘চতুরঙ্গ’ (২০০৮), মনোজ সেনের ‘ছুটি’ (২০০৬), কতুপর্ণ ঘোষের ‘নৌকাডুবি’ (২০১১) ইত্যাদি। সম্প্রতি যোগাযোগ অবলম্বনে ছবির কাজ শুরু করেছেন শেখর দাশ। চলচ্চিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা আজ থেকে ৭৫/৮০ বছর আগে করা হলেও এখনও অতি প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক। আর চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রকাহিনির আধুনিক ও শিল্পসফল রূপান্তর এখনও একাধিক সত্যজিতের অসমাপ্ত প্রয়াসের কাজ। সমাপ্তিতে আমরা টেলিভিশনে রবীন্দ্রকাহিনির চিত্ররূপ ও বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগের কথাও উল্লেখ করতে পারি। অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় নির্মিত রবীন্দ্রচলচ্চিত্রের কথাও।

[ বলা হয়েছে, যেসব দেশে গণমাধ্যমের চূড়ান্ত প্রসার ঘটেছে সেখানে অতি আধুনিক দর্শকের/পাঠকের ব্যক্তিকল্পনা আজ মিশে যাচ্ছে অনমনীয় সমষ্টিকল্পনার জগতের সঙ্গে। কল্পনার সেই নান্দনিকতার প্রসঙ্গে উপন্যাস বনাম গণমাধ্যম আজকের একটা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এইভাবে বাইশ শতকে ‘নষ্টনীড়’ হয়তো টিকে থাকবে ‘চারুলতা’ ফিল্ম হিসেবে।।

চলচ্চিত্র সমূহ —

  • ১৯২৩ মানভঞ্জন।
  • ১৯২৮ বিসর্জন’
  • ১৯২৯ বিচারক
  • ১৯৩০ গিরিবালা, দালিয়া
  • ১৯৩২ নৌকাডুবি, নটীর পূজা চিরকুমার সভা’
  • ১৯৩৭ মুক্তি;
  • ১৯৩৮ হাল বাংলা, শখের শ্রমিক. চোখের বালি, গোরা
  • ১৯৩৯ অধিকার, পথিক, জীবন মরণ:
  • ১৯৪০ পরাজয়, আলোছায়া, ডাক্তার
  • ১৯৪১ রাসপূর্ণিমা, পরিচয়, আহুতি, উত্তরায়ণ:
  • ১৯৪২ অপরাধ, গরমিল, পরিণীতা, শোধবোধ”:
  • ১৯৪৩ প্রিয় বান্ধবী, সহধর্মিণী, দম্পতি:
  • ১৯৪৪ গোঁজামিল, উদয়ের পথে, প্রতিকার, শেষ রক্ষা*
  • ১৯৪৫ পথ বেঁধে দিল।
  • ১৯৪৬ শান্তি, নিবেদিতা, দুঃখে যাদের জীবন গড়া, পরিণীতা,
  • ১৯৪৭ অভিযাত্রী, নৌকাডুবি * অলকানন্দা, ঘরোয়া
  • ১৯৪৮ প্ৰতিবাদ, দৃষ্টিদান’, ভুলি নাই, অনির্বাণ, অঞ্জনগড়, ধাত্রী দেবতা, শ্যামলের স্বপ্ন:
  • ১৯৪৯ মন্ত্রমুগ্ধ, রাঙামাটি, কামনা, অনন্যা, বিষের ধোঁয়া, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার পৃষ্ঠন:
  • ১৯৫০ তথাপি, পিভ্রোন্ত,
  • ১৯৫১ অপরাজিতা, দর্পচূর্ণ, দত্তা
  • ১৯৫২ সহস্রা
  • ১৯৫৩ মালঞ্চ, বউঠাকুরাণীর হাট শেষের কবিতা
  • ১৯৫৪ অসুখ, সতী, যদুভট্ট, ভাঙাগড়া,
  • ১৯৫৫ সাজঘর, চিত্রাঙ্গদা’, ভালোবাসা:
  • ১৯৫৬ শুভযাত্রী, চিরকুমার সভা* পানের মর্যাদা
  • ১৯৫৭ কাবুলিওয়ালা,
  • ১৯৫৮ যোগাযোগ কালামাটি, লুকোচুরি।
  • ১৯৫৯ বিচারক, পুষ্পধনু, নৃত্যেরই তালে তালে:
  • ১৯৬০ মেঘে ঢাকা তারা, ক্ষুধিত পাষাণ খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন শুন বরনারী
  • ১৯৬১ কোমল গান্ধার, তিনকন্যা (মণিহারা, সমাপ্তি, পোষ্টমাষ্টার)”, নেকলেস, আহ্বান, সন্ধ্যার, অর্থ (পুরাতন ভৃত্য, পূজারিণী, দুই বিঘা জমি, অভিসার),
  • ১৯৬২ কাচের স্বর্গ, সূর্যস্নান, সাথী, কান্না, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কুমারী মন,
  • ১৯৬৩ নিশীথে, নির্জন সৈকতে, ছায়াসুর্য, বর্ণালী:
  • ১৯৬৪ কালস্রোত, প্রতিনিধি, বিভাস, জতুগৃহ, চারুলতা, সিঁদুরে মেঘ, আয়নাও, নতুন তীর্থ, মোমের আলো, সন্ধ্যা দীপের শিখা, অনুষ্টুপ ছন্দ, সুভা ও দেবতার গ্রাস *
  • ১৯৬৫ আলোর পিপাসা, বাক্সবদল, অতিথি, প্রথম প্রেম, সুবর্ণরেখা, একটুকু ছোঁয়া লাগে, একই অঙ্গে এত রূপ,
  • ১৯৬৬ সুভাষচন্দ্র, স্বপ্ন নিয়ে
  • ১৯৬৭ ছুটি, গৃহদাহ, বালিকা বসু, আকাশ ছোঁয়া, মহাশ্বেতা, হাটে বাজারে,
  • ১৯৬৮ পঞ্চশর, চারণকবি মুকুন্দদাস, চৌরঙ্গী, আপনজন,
  • ১৯৬৯ দুরন্ত চড়াই, তিন ভুবনের পারে, অগ্নিযুগের কাহিনী, আরোগ্য নিকেতন:
  • ১৯৭০ দিবারাত্রির কাব্য, শান্তি, মেঘ ও রৌদ্র, ইচ্ছাপূরণ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন,
  • ১৯৭১ নবরাগ, মাল্যদান নিমন্ত্রণ, কুহেলি, জয় বাংলা, খুঁজে বেড়াই, মহাবিপ্লবী অরবিন্দ;
  • ১৯৭২ আলো আমার আলো, অনিন্দিতা, শপথ নিলাম, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা, মেম সাহেব:
  • ১৯৭৩ বনপলাশির পদাবলী, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, স্ত্রীর পত্র,
  • ১৯৭৪ বিকেলে ভোরের ফুল, বিসর্জন’ ছন্দপতন, ছেঁড়া তমসুক, একদিন সূর্য, যদি জানতেম, যদুবংশ, যে যেখানে দাঁড়িয়ে, সুজাতা, ঠগিনী:
  • ১৯৭৫ অগ্নীশ্বর, নতুন সূর্য, কাজললতা,
  • ১৯৭৬ জন- অরণ্য, দত্তা, অসময়, অর্জুন,
  • ১৯৭৭ স্বাতী এই পৃথিবীর পান্থনিবাস, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, প্রতিশ্রুতি, শেষ রক্ষা,
  • ১৯৭৮ সৃষ্টিছাড়া, অবতার;
  • ১৯৭৯ দৌড়, পরিচয়, নৌকাডুবি,
  • ১৯৮০ দাদার কীর্তি;
  • ১৯৮১ সাহেব
  • ১৯৮২ বিজয়িনী, মেঘমুক্তি, মালঞ্চ,
  • ১৯৮৪ দীপার প্রেম, পারাবত প্রিয়া,
  • ১৯৮৫ দিদি, অন্বেষণ, ভালবাসা ভালবাসা, ঘরে বাইরে হুলুস্থুল,
  • ১৯৮৬ জীবন, কোনি, পরিণতি, পথভোলা, ছেলেটা, রবিবার
  • ১৯৮৭ অর্পণ, চপার, মহামিলন, রুদ্রবীণা:
  • ১৯৯০ একটি জীবন,
  • ১৯৯২ আগন্তুক, অনন্যা, অন্তর্ধান, শাখা- প্রশাখা, শ্বেত পাথরের থালা,
  • ১৯৯৩ পাষণ্ড পণ্ডিত, পৃথিবীর শেষ স্টেশন:
  • ১৯৯৪ লাঠি, রবিবার, সন্ধ্যাতারা, হুইল চেয়ার
  • ১৯৯৭ কালরাত্রি, নয়নতারা, নির্জন দ্বীপ:
  • ১৯৯৮ অরণ্যের অধিকার, মিশ্ররাগ, শেষের কবিতা,
  • ১৯৯৯ অনু,
  • ২০০০ পারমিতার একদিন, চল লেটস গো,
  • ২০০১ তিতলি
  • ২০০৩ আলো, চোখের বালি,
  • ২০০৬ পিতা- চিরসখা হে,
  • ২০০৮ ছুটি, চতুরঙ্গ রঙীন গোধুলি,
  • ২০০৯ স্মৃতিমেদুর, জীনা, হাসি খুশি ক্লাব।
  • ১৯৪৭ মিলন,
  • ১৯৫১ জ্বলজ্বলা, ফুলওয়ারী,
  • ১৯৬২ কাবুলিওয়ালা,
  • ১৯৭১ উপহার
  • ১৯৯১ লেকিন।

প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ:

অরুণকুমার রায়ের চলচ্চিত্র ও রবীন্দ্রনাথ।

প্রামাণিক চিত্র: সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্রনাথ।।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is Free!!